বর্বরিক হলেন ভীম পুত্র ঘটোৎকচের ছেলে। তিনি একজন মহাবীর এবং একই সাথে তিনি কৃষ্ণ ভক্ত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ এবং গীতার সাক্ষী ছিলেন যারা তাদের মধ্যে বর্বরিক একজন। বর্বরিক ছাড়া সঞ্জয়, অর্জুন ও হনুমান কুরুক্ষেত্রের সমগ্র ঘটনার সাক্ষী ছিলেন।
একবার কৃষ্ণের সাথে মুরা নামক অসুরের যুদ্ধ শুরু হয় এই যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ মুরা সহ সমস্ত অসুরকে বধ করে। এই খবর শুনে মুরার মেয়ে কামকালিকা তার সমস্ত অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আসে। কামকালিকা নিজে দুর্গার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি দেবী দুর্গার থেকে যে সকল অস্ত্র পেয়েছিলেন সেই সমস্ত অস্ত্রই শ্রীকৃষ্ণের দিকে প্রয়োগ করতে শুরু করেন কিন্তু ভগবানের শ্রী অঙ্গে লেগে সমস্ত অস্ত্রই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এরপর শ্রীকৃষ্ণ অসুর কন্যাকে বধ করতে সুদর্শন চক্র ধারণ করলে মা দুর্গা স্বয়ং প্রকট হয় ভগবান কামকালিকার কাছে প্রার্থনা করেন এবং কামকালিকার কাছে ভগবানের পরিচয় দেন। ভগবানের পরিচয় পেয়ে কামকালিকা ভগবানের কাছে ক্ষমা চান। ভগবান তখন প্রসন্ন হয়ে ভীম পুত্র ঘটোৎকচ এর সাথে তার বিয়ে ঠিক করেন। ঘটোৎকচ তার মাতা হিড়িম্বার আশীর্বাদ নিয়ে অসুর কন্যাকে বিবাহ করে। এরপর ঘটোৎকচ ও কামকালিকার পুত্র বর্বরিকের জন্ম হয়। হিড়িম্বা সেই ছেলেকে ছোট থেকেই ধর্মীয় কাহিনী শোনাতে শুরু করে,ফলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে ভক্ত হয়ে ওঠে।
বর্বরিক তার ঠাকুমার কাছে জানতে চেয়েছিলো মোক্ষ প্রাপ্তির সবচেয়ে সহজ উপায় কী? হিড়িম্বা তখন বলেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতে যার বধ হয়, তার তৎক্ষণাৎ মোক্ষ প্রাপ্তি হয়। এই কথা শুনে বালক বর্বরিক বলে, আমি তাহলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে গিয়ে বলছি তার সুদর্শন চক্র দিয়ে আমায় বধ করতে। বালকের এই কথা শুনে হিড়িম্বা হাসতে হাসতে বলে, ভগবান এমনি তাকে মারবেনা ভগবানের হাতে বধ হতে চাইলে তাকে ভগবানের সমকক্ষ যোদ্ধা হতে হবে।
এরপর ভগবানের হাতে বধ হওয়ার অভিলাষে বর্বরিক মা দুর্গার কঠোর তপস্যা করেন মা দুর্গার থেকে সমস্ত অস্ত্র প্রাপ্ত হওয়ার পর তিনি আবার সিদ্ধি মাতার উপাসনা শুরু করেন ও তার কাছ থেকেও বাসুদেব সহ অন্যান্য আরো অনেক অস্ত্র লাভ করেন। এইভাবে বর্বরিক অজেয় হয়ে ওঠেন, একমাত্র কৃষ্ণ ব্যতীত কেউই আর তাকে মারতে সক্ষম হন না।
যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হয় তখন বর্বরিক কৌরব এর পক্ষে যোগ দেওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করেন পথে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণ বেশে এসে তার পথ আটকায়। ভগবান বর্বরিককে জিজ্ঞেস করেন তিনি কোথায় চলেছেন। বর্বরিক নিজের উদ্দেশ্য জানালে ভগবান বলেন, তোমার তো কোনো সৈন্য নেই! আর তুমি মাত্র তিনটি বান নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে এসেছো!
বর্বরিক এর উত্তরে জানান, একটি বানের দ্বারাই তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ করে দিতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণ তার পরীক্ষা করবার জন্য বলেন, এই বট গাছের সমস্ত পাতা ছেদ করে দেখাও। শ্রীকৃষ্ণ কৌশলে একটি পাতা হাতের মুঠোয় এবং একটি পাতা নিজের পায়ের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু বর্বরিক গাছের সকল পাতা ছেদ করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রী কৃষ্ণের লুকিয়ে রাখা দুটি পাতাও ছেদ করে দেন। শ্রীকৃষ্ণ তখন বর্বরিককে উত্তেজিত করতে বলেন যে, গাছের পাতা ছেদ করতে পারলেও সে পান্ডবদের বধ করতে পারবে না।
এই কথা শুনে বর্বরিক পান্ডবদের মারবার জন্য ধনুর্বাণ মারতে উদ্যত হলেই কৃষ্ণ তার সুদর্শন চক্র দিয়ে বর্বরিকের মাথা কেটে ফেলেন এবং নিজস্ব রূপে এসে নিজের পরিচয় দেন। বর্বরিক ভগবানের পরিচয় পেয়ে বলেন, ভগবান আমি প্রথমেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম এবং আপনার হাতে বধ্য হওয়ার জন্যই এই কাজ করেছিলাম। এখন শুধু আমার একটি প্রার্থনা পূর্ণ করুন আমি যাতে এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটি দেখতে পারি তার ব্যবস্থা করুন। কৃষ্ণ তথাস্তু বলে বর্বরিক এর মাথাটিকে জীবিত রাখেন। এই মাথাটিকে ভগবান কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সবথেকে উঁচু স্থানে রাখেন যাতে বর্বরিক সমস্ত যুদ্ধই দেখতে পায়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর যখন পঞ্চপান্ডবরা নিজেদের পরাক্রমের বিষয় নিয়ে প্রশংসা করছিল সেই সময় বর্বরিক অট্টহাসি হাসতে থাকে। হাসি শুনে পঞ্চপান্ডব বেরিয়ে হাসির কারণ জানতে চাইলে বর্বরিক বলে যে তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছেন অর্জুন, ভীম, যুধিষ্ঠির, নকুল অথবা সহদেব নয়, এই সমগ্র যুদ্ধে একমাত্র যোদ্ধা ছিলেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ। অর্জুন বা ভীম বা যোদ্ধাদের কেউই তাদের অস্ত্রের দ্বারা কাউকে বধ করবার আগেই শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের দ্বারাই তারা বধ হচ্ছিলেন এবং অনান্য যোদ্ধারা শুধুমাত্র সেই মৃত ব্যক্তিদেরকেই পুনরায় মারছিলেন। বর্বরিকের মুখে এই কথা শুনে প্রত্যেকেই বুঝতে পারলেন, ভগবানের মাহাত্ম্য আর যুদ্ধের বিবরণ দেওয়ার পর বর্বরিকও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেহের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। অর্থাৎ তার মনোবাসনা পূর্ণ হল, বর্বরিকের মোক্ষ প্রাপ্তি হল।