সনাতন ধর্মে অসংখ্য সতী রয়েছেন, সাবিত্রী, অরুন্ধতী এদের মধ্যে অন্যতম। আবার সতী হিসেবে সর্বাগ্রে রয়েছে সীতার নাম, যিনি পবিত্রতার সাক্ষাৎ উদাহরণ। এই সকল সতীদের ছাড়াও সনাতন ধর্মে রয়েছে পঞ্চকন্যা বা পঞ্চসতী। এই পাঁচজন কন্যার জীবন একই ছকে বাঁধা অনেকখানি তাই পঞ্চসতী হিসেবে একসাথে এদের নাম স্মরণ করা হয়। এই পঞ্চসতী হলেন অহল্যা, দ্রোপদী, তারা, কুন্তি ও মন্দোদরী।
পঞ্চসতীর পরিচয়: ঋষি গৌতম এর স্ত্রী হলেন অহল্যা, পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী হলেন দ্রোপদী, তিনি দ্রুপদ রাজার কন্যা। বানর রাজা বালির স্ত্রী হলেন তারা, মহাভারতে রাজা পান্ডুর স্ত্রী কুন্তী ও রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী। এরা হলেন পাঁচজন নারী, সনাতন ধর্মে বলা হয় যে, এই পঞ্চকন্যা কে প্রতিদিন যদি কেউ স্মরণ করেন তাহলে তার সমস্ত পাপ ধুয়ে যায় ।
১। অহিল্যা:
বাল্মিকী রামায়ণের অহল্যার কাহিনী শুনতে পাওয়া যায়। অহল্যা ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী, ভদ্র ও গুণী মহিলা। মহর্ষি গৌতম কে তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং স্বামীর সাধনার পথে সব সময় তিনি সহায়তা করতেন। দুজনে বনে থেকে তপস্যা ও ধ্যান করতেন।
সনাতন ধর্মে বলা হয় শচীপতি ইন্দ্র মহর্ষি গৌতমের ছদ্মবেশ ধারণ করে অহল্যার সাথে সহবাস করেছিলেন। এতে অহল্যার কোন দোষ ছিলো না। ঋষি গৌতম প্রতিদিন যেমন স্নান করতে আশ্রম থেকে বেরোন সেইরকমই তিনি সকালে স্নান করতে বার হয়েছিলেন, কিন্তু আশ্রম থেকে বেরোনোর পর গৌতম মুনি বুঝতে পারলেন যে রাত এখনো অনেক বাকি আছে, তখন তিনি আবার আশ্রম ফেরত গেলেন। আশ্রমে পৌঁছানোর পর তিনি দেখলেন যে ইন্দ্র তার আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসছেন। তিনি ইন্দ্রকে খুব ভাল করেই চিনতেন, ইন্দ্রের ছলনা ও অপকর্মের কথা বুঝতে পেরে ঋষি ক্রুদ্ধ হয়ে
ইন্দ্র ও তাঁর পত্নী অহল্যাকে অভিশাপ দেন।
অহল্যা যখন কাঁদতে কাঁদতে বারংবার বলতে থাকেন যে, তিনি নিরাপরাধ এবং এতে তার কোন দোষ নেই। তখন গৌতম মুনি বলেন যে তুমি এখানে পাথরের মত বাস করবে। ভগবান বিষ্ণু যখন ত্রেতা যুগে রাম অবতারে অবতীর্ণ হবেন তখন তার পবিত্র পদস্পর্শে তুমি তোমার এই পাষাণ জীবন থেকে মুক্তি হবে। সীতাপতি শ্রীরাম ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ হওয়ার পর অহল্যার পাষাণ মুক্তি ঘটেছিল।
২। দ্রৌপদী:
মহাভারতে দ্রৌপদীর কথা উল্লেখিত আছে। দ্রৌপদীও পঞ্চ সতীর মধ্যে একজন। যজ্ঞের আগুন থেকে উত্থিত হয়েছিলেন দ্রোপদী তাই তাকে যাজ্ঞসেনী বলা হয়। পাঞ্চাল প্রদেশের কন্যা ছিলেন বলে তার নাম ছিল পাঞ্চালি। ইনি ছিলেন অত্যন্ত পবিত্র ও ধার্মিক নারী। পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী ছিলেন দ্রোপদী। মামা শকুনির সাথে পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি রেখে ছিলেন। দুর্যোধনের কথায় দুঃশাসন যখন ভরা সভায় দ্রোপদীর বস্ত্র হরণের প্রয়াস করতে যায় তখন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাকে রক্ষা করেন, চতুর্দিক থেকে বস্ত্র এসে দ্রৌপদীকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। দুঃশাসন যত বস্ত্র টানতে থাকে, তত রঙিন কাপড় বার হতে থাকে, ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে দুঃশাসন আর সম্মান রক্ষা পায় দ্রোপদীর।
৩। তারা:
তারা ছিলেন এক অপ্সরা, ইনি সমুদ্রমন্থনের সময় বেরিয়ে এসেছিলেন। তারার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বালি ও সুশেন দুজনেই তাকে স্ত্রী বানাতে চেয়েছিলেন। সেই সময় বলা হয়েছিল যে তারার বাম দিকে যে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি তার স্বামী হবেন এবং ডান দিকে যে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি তার বাবা হবেন। এরপর বালির সাথে তারার বিয়ে হয়।
রামচন্দ্র যখন বালিকে হত্যা করেন তখন তারা অত্যন্ত দুঃখিত হন। রামচন্দ্র বালিকে ছলনার দ্বারা হত্যা করেছিলেন, তাই বালির স্ত্রী তারা তখন শ্রীরামকে অভিশাপ দেন যে, রাম তার স্ত্রী সীতাকে খুঁজে পাওয়ার পরপরই হারাবেন এবং পরবর্তী জীবনে শ্রী রাম তার স্বামী বালির দ্বারাই নিহত হবেন। বাস্তবে এমনটাই হয়েছিল। শ্রী রাম সীতাকে খুঁজে পাওয়ার পরপরই তাকে বনবাসে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন আর রামচন্দ্রের পরবর্তী জন্মে রামচন্দ্র যখন প্রশ্ন হন তখন এক শিকারীর দ্বারা তিনি নিহত হন। এই শিকারি ছিলেন পূর্ব জন্মের বালি।
৪। কুন্তী:
যদু বংশীয় রাজা শুরসেনের পৃথা নামের একটি কন্যা ছিল। এই পৃথাকেই নিঃসন্তান রাজা কুন্তিভোজ দত্তক নিয়েছিলেন এবং তার নাম রেখেছিলেন কুন্তি। এই ভাবেই জন্মের পর থেকে পৃথা তার মা-বাবার থেকে দূরে ছিল। কুন্তি অত্যন্ত অতিথি বৎসলা ছিলেন। তিনি তার প্রাসাদে আসা সকল অতিথিদের সেবা করতেন, এই ভাবেই তিনি ঋষি দুর্বাসাকে সেবা করে তার থেকে একটি বর পেয়েছিলেন অর্থাৎ তিনি একটি মন্ত্র পেয়েছিলেন। যে মন্ত্রের প্রভাবের ফলে কুন্তি স্মরণ করলেই যে কোন দেবতা তার সামনে উপস্থিত হবে এবং সেই দেবতা কুন্তীর ইচ্ছা পূরণ করবেন। হস্তিনাপুরের রাজা পান্ডুর সাথে কুন্তির বিয়ে হয়। কুন্তির চার পুত্র ছিল- কর্ণ, যুধিষ্ঠির, ভীম,অর্জুন।
৫। মন্দোদরী:
পঞ্চকন্যার মধ্যে আর একজন ছিলেন মন্দোদরী। ইনি রাবণের স্ত্রী ছিলেন। মন্দোদরী ভগবান মহাদেবের কাছ থেকে বর চেয়েছিলেন যে, তার স্বামী যেন পৃথিবীর সবচেয়ে শিক্ষিত ও শক্তিশালী ব্যক্তি হন। মহাদেবের বরেই রাবনকে স্বামী হিসেবে পান মন্দোদরী।