প্রত্যেকটা সৃষ্টির আগে একটা ইতিহাস থাকে, সেই ইতিহাস কখনো কখনো প্রকাশ্যে আসে, ফলাও করে তা সকলের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। কখনো কখনো বা তা ঘুমিয়ে থাকে সকলের অগোচরে। ইতিহাসে দেখা গিয়েছে সমস্ত সাম্রাজ্য সৃষ্টির আগে ইতিহাস রয়েছে, ইতিহাস লুকিয়ে আছে স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও তবে রাস্তার ক্ষেত্রে? রাস্তার ক্ষেত্রে কি সত্যি কোনো ইতিহাস নেই? নাকি কিলোমিটারের পর কিলোমিটার জুড়ে থাকা দীর্ঘ রাস্তা গুলোর ইতিহাস কখনো জানার চেষ্টাই করা হয় না? আজ সেই ইতিহাসের খোঁজেই ছুটেছি আমরা।
কলকাতা শহরের জনপ্রিয় একটি রাস্তা রেড রোড। কলকাতার প্রাচীন এই রাস্তাটি ফোর্ট উইলিয়ামের পশ্চিম গেটের দক্ষিণ দিক দিক থেকে শুরু হয়ে ইডেন গার্ডেন পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এই রেড রোডে প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে কুচকাওয়াজ করা হয়, প্রতিবছর প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন বর্ণাঢ্যভাবে কুচকাওয়াজ হয় এই রেড রোডে। আবার ঈদ-উল-ফিতরের দিন হাজার হাজার মানুষ এখানে সমবেত হয়ে নামাজ পড়েন। আবার বিগত কয়েক বছর ধরে কলকাতার বিভিন্ন জায়গার দুর্গাপুজোর কার্নিভাল এই রেডরোডেই অনুষ্ঠিত হয়। দিনের বেলা কত মানুষের যাতায়াত হয় এই রাস্তার ওপর দিয়ে, কত গাড়ি ঘোড়া চলে, কত কোলাহল কত মানুষ। কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন এই রেড রোডের প্রাচীন ইতিহাস কজনই বা জানেন? কেনই বা এই রাস্তার নাম রেড রোড হলো? কীভাবেই বা হলো জানেন? রেড রোড নামকরণের পিছনেই বা কী ইতিহাস জড়িয়ে আছে চলুন জেনে নিই…
কলকাতা শহরের শতাব্দী প্রাচীন এই রাস্তা গুলির মধ্যে রেড রোড অন্যতম একটি রাস্তা। এই রাস্তাটি দীর্ঘ দুই কিলোমিটারের ও বেশি দীর্ঘ। রাস্তার নাম রেড রোড হলেও এই রাস্তার রং আসলে কিন্তু লাল নয়। এই রাস্তার রং হলো ধূসর বর্ণের। তবে এই রাস্তার নাম রেড রোড হওয়ার পিছনে একটি বিশেষ কারন আছে। এই রাস্তা যখন তৈরি হয় সেই সময় লাল নুড়ির ব্যবহার করা হয়েছিলো প্রচুর পরিমাণে, যার ফলে এই রাস্তার নাম রেড রোড।
ঐতিহাসিকরা বলেন যে, এই রাস্তা যখন প্রথম তৈরি হচ্ছিল তখন পুরো রাস্তাটিই ইটের কুচি দিয়ে ভরা ছিলো,ফলে লাল রঙের ধুলো উড়তো হাওয়ায়। তাই সেই থেকেই মানুষ জনের মুখে মুখে এই রাস্তার নাম হয়ে গেলো ‘রেডরোড’, পরবর্তীকালে এই রেড রোডের নাম বদল হলেও লোকমুখে তা রেড রোডই থেকে গিয়েছিলো।
বিগত চার দশক আগে ১৯৮৫ সালের কোনো এক সময়ে ভারতবর্ষের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নাম অনুসারে এই রাস্তাটির নাম করা হয়েছিলো ইন্দিরা গান্ধী সরণী। তবে এই নামটি সেভাবে কেউ ব্যবহার করেন না, ফলে এই নামটি খাতায়-কলমেই রয়ে গিয়েছে।
স্থানীয় মানুষজন তো রেড রোডকে ইন্দিরা গান্ধীর সরণি বলেন ই না আবার তারা ট্যাক্সিচালককে কোথাও যাওয়ার জন্য যখন ঠিকানা বলেন তখনও রেড রোড বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।এই রাস্তাটির খাতায়-কলমে থাকা নাম ইন্দিরা গান্ধী সরণীর কথা তাই অনেকেই হয়তো জানেন না।
১৮২০ সালে এই রাস্তাটি তৈরি হয়েছিলো। এই রাস্তাটি যখন প্রথম নির্মিত হয় তখন এই রাস্তার নাম ছিল ‘সেক্রেটারিজ ওয়াক’। সেই সময়কার গভর্নর জেনারেলের বাসভবন অর্থাৎ বর্তমানের যেটি রাজভবন তার সাথে দক্ষিণ শহরতলি জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করবার জন্যই এই রাস্তা তৈরি করা হয়েছিলো। তবে পরবর্তীকালে খিদিরপুর হয়ে হাউজ স্ট্রিট , ব্রেবোর্ন রোড অথবা শহরের অন্যান্য প্রান্তে যেতেও সরকারি আধিকারিকরা এই বাইপাস ধরেই গাড়ি করে যেতেন। সরকারি আধিকারিকদের এই চলাফেরার কারণেই এই রাস্তার নাম হয় সেক্রেটারিজ ওয়াক।
রেড রোডকে ‘লেডিজ মাইল’ও বলা হতো। হ্যাঁ এটি অন্য একটি নাম। শহরের মধ্যে সবথেকে ব্যস্ততম এই রাস্তাতেই দিনের বেলা সরকারি আধিকারিকরা যেমন গাড়ি নিয়ে ছুটে যেতেন অফিস কাছারি যাওয়ার জন্য, তেমনই বিকেলের দিকে সাদা গাউন পরিহিত শ্বেতাঙ্গীরা দলবেঁধে এই রাস্তা দিয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে যেতেন। তাদের সবার হাঁটার ভঙ্গিমা ছিলো ধীর স্থির, তারা গল্প করতেন আর হাঁটতেন তাই তাদের হাঁটার মধ্যে কোনো তাড়া ছিলো না। শ্বেতাঙ্গীদের এই ইভিনিং ওয়াকের জন্য ঐতিহাসিকরা এই রাস্তার নাম দিয়ে দেন ‘লেডিজ মাইল’।
ঐতিহাসিক এই রেড রোড আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমগ্র বিশ্বের পরিস্থিতি যখন ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তখন ফাইটার বিমানের ল্যান্ডিং স্ট্রিপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিলো রেড রোডকে। যদিও এয়ার স্ট্রিপ হিসেবে ব্যবহারের জন্য এই রাস্তাটি একদম নিখুঁত ছিলো না, তবুও ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল অবধি প্রায় তিন বছর এই রাস্তাটিকে এয়ারস্ট্রিপ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এই রেড রোডেই যুদ্ধবিমানের অবতরণ হতো। তাই স্থানীয়রা বলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষের হৃদয়ের আগুন, প্রতিশোধ,বিপ্লব,রক্ত সবকিছুর সাক্ষ্য এই রাস্তা,সেই কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই রেড রোড নামটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অনেকে আবার বলেন, যুদ্ধ বিমানে আসতেন আহত সৈনিকেরা,তাদের গা থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত মিশে যেতো এই রাস্তায় তাই এই রাস্তার নাম রেড রোড।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শতাব্দী প্রাচীন এই রাস্তার দুইপাশে অতীতে প্রচুর গাছপালা ছিল, ছিল সবুজের সমাহার। তবে, সময়ের সাথে সাথে আজ গাছপালার সংখ্যা অনেকখানি কমে গেছে, রাস্তার চেহারাও তাই আর আগের মত নেই,পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তবু ইতিহাসের দলিল রূপে আজও রয়ে গেছে রেড রোড, প্রতিনিয়ত এই রাস্তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষ্য প্রমাণ করে চলেছে নীরবে।