জঙ্গিবিধ্বস্ত একটা দেশ, বিধিনিষেধের জীবন। যেখানে ইচ্ছেমতো বাঁচা যায় না। সারাক্ষণ জঙ্গিদের গোপন নজরদারি। পোশাক পরিচ্ছদের স্বাধীনতা নেই, মেয়েদের পড়াশোনা করে এগোনোর রাস্তাতেও তালিবানি ফতোয়া। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের হেরাত শহরে জন্মগ্রহণ করেন নাদিয়া নাদিম। নাদিয়া নাদিম সেই আগুনপাখি, যিনি শরনার্থীর জীবন থেকে বিশ্ব ফুটবলে হইচই ফেলে দিয়েছেন।
নাদিয়ার বাবা ছিলেন আফগান সেনাবাহিনীর সদস্য। তাঁর বয়স যখন ১১ বছর, বাবা ধরা পড়লেন তালিবান জঙ্গিদের হাতে। জঙ্গিরা বাবাকে হত্যা করার পর তাঁদের জীবনে নেমে আসে তুমুল অনিশ্চয়তা। বাঁচার তাগিদে পুরো পরিবার ট্রাকে চেপে পাড়ি জমান ডেনমার্কে। আশ্রয় পান সেখানকার শরণার্থী শিবিরে। স্বপ্ন দেখার শুরু শেখানেই। শরনার্থী শিবিরের নানান প্রতিকূলতার মধ্যে পিছিয়ে থাকেননি নাদিয়া। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলাকেই মুক্তির পথ হিসেবে বেছে নেন৷
ফেলে আসা আফগানিস্তানের জীবন তখন অতীত। গোলাগুলি, ঝলসানো দেহ, রক্তের স্রোত, গুম করে খুন ইত্যাদি থেকে বহু দূরে নিজেকে বিশ্বের দরবারে মেলে ধরার চেষ্টা করছিলেন নাদিয়া। নাদিয়া নাদিমের পরিবার ডেনমার্কের শরণার্থী শিবিরে থাকার সময়ই ফুটবল কেরিয়ার শুরু করেন। শুরুতে বি৫২ আলবোর্গ এবং এরপর টিম ভিবর্গের হয়ে খেলেন। এরপর সেখান থেকে তিনি পাড়ি জমান স্কাই ব্লু এফসিতে। তারপরের গন্তব্য ছিল ফ্লান্সের পিএসজি। সেখান থেকে রেসিং লুইসভিলে এফসি। ২০১৮ সালে ম্যানসিটিতেও খেলেছেন তিনি।
২০০৯ সালে নাদিয়ার ডেনমার্ক জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ঘটে। এরপর খেলেছেন ৯৮টি ম্যাচ। গোলও করেছেন ৩৮টি। ক্লাব ফুটবলে তাঁর প্রায় ২০০ টি গোল রয়েছে৷ নাদিয়া নাদিমের স্বপ্ন ডেনমার্কের হয়ে শততম ম্যাচ খেলা। নাদিয়ার বর্তমান বয়স ৩৩ বছর। কিন্তু তিনি এখনই থামতে চান না। এগিয়ে যেতে চান আরো অনেক দূর।
নাদিয়া শুধু একজন ফুটবলারই নন, তিনি আরহাস ইউনিভার্সিটির একজন মেডিক্যাল ছাত্রী। ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর ডিগ্রি সম্পূর্ণ করবেন ঠিক করেছেন। নাদিয়া নাদিমের অবিশ্বাস্য জীবনকাহিনী আগেই তাঁর আত্মজীবনীতে প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু সম্প্রতি এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় আবার প্রচারের আলোয় আসতে শুরু করেছে। নাদিয়া কথা বলতে পারেন মোট ১১টি ভাষায়। খেলাধুলার বাইরে নানান সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ফোর্বসের মোস্ট পাওয়ারফুল ওমেন ইন ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টসের তালিকায় উঠে আসে তাঁর নাম।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে নাদিয়া তাঁর ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ‘আমরা ঠিক করেছিলাম লন্ডনে পালিয়ে যাব, যেখানে আমাদের জনাকয়েক আত্মীয় রয়েছেন। সেইমতো আমরা জাল পাসপোর্ট নিয়ে পাকিস্তান হয়ে ইতালি যাই। সেখান থেকে আমি এবং আমার পরিবার ট্রাকে চেপে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাই। কিছুদিন পর আমাদের যাত্রা শেষ হয়। আমরা ভেবেছিলাম ট্রাক থেকে নেমেই সামনে লন্ডনের বিগ বেন দেখতে পাবো। কিন্তু আমরা কেবল চারপাশে গাছগাছালি দেখতে পাই। একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি আমরা ডেনমার্কে এসে পৌঁছেছি।’
কট্টর তালিবানি নজরদারিতে আর পাঁচটা সাধারণ আফগান নারীর মতো কেটে যেতে পারত নাদিয়ার জীবন। অকালে পিতৃহারা হয়ে শরনার্থী শিবিরে গেলেও জীবন তাঁকে সুযোগ দিয়েছিল নিজেকে প্রমাণ করার। ফুটবল তাঁর মুক্তির পথ। ধর্মের দোহাই দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখা, পড়াশোনা করা সুযোগ না দেওয়ার বিরুদ্ধে তাঁর সুস্থচিন্তার জিহাদ মুক্ত হতে চাওয়া মেয়েদের পথ দেখাবে। ‘ছোট পোশাকে খেলাধুলো করা যাবে না। অমান্য করলে গর্দান যাবে’ জাতীয় হুমকির বিপরীতে নাদিয়ারা ডানা মেলেছেন। হয়ে উঠছেন নারীশক্তি জাগরণের উজ্জ্বল উদাহরণ।